নজরদারি, গোপনীয়তা আর সুরক্ষা
নানা ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের ওপর এক অভূতপুর্ব নজরদারির যুগ নিয়ে এসেছে। লাগামছাড়া ডাটা সঞ্চয় আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তারক্ষার মধ্যে যে সহজাত বিরোধ আছে, তা নানা দেশের সরকারকে নানা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ‘বিস্মৃত হওয়ার অধিকার’ আইনের চোখে মান্যতা পেয়েছে, আর বিভিন্ন সংস্থা ব্যক্তিগত ডাটা কি কি ভাবে ব্যবহার করতে পারে তাতে লাগাম লাগিয়েছে এক নতুন ডাটা সুরক্ষা আইন। সাম্প্রতিককালে এডওয়ার্ড স্নোডেন ও অন্যদের করা নানা পর্দাফাঁস এটাই প্রমাণ করেছে যে বিভিন্ন দেশের সরকার (ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশেরও) কিভাবে তাদের নাগরিকদের ওপর নজরদারি চালায় আর মানবাধিকাররক্ষীদের কোনও ন্যায্য কারণ ছাড়াই নজরবন্দী রাখে।
অসাম্য ডিজিটাল যুগের নজরদারি ও গোপনীয়তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যখন বিশেষাধিকার হয়ে দাঁড়ায়, ভূগোলকীয় উত্তরে যা সুরক্ষিত, তখন ধরেই নেওয়া যায় ভূগোলকীয় দক্ষিণে ডাটা নিষ্কাশনের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
ডিজিটাল নজরদারির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক মাত্রা আছে। মানবাধিকাররক্ষী আর রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের বেছে বেছে প্রায়শঃই নজরবন্দী করা হয়। ট্যাক্টিক্যাল টেকনোলজি কালেক্টিভের গবেষণায় প্রকাশ, রাষ্ট্র অহরহ মানবাধিকাররক্ষীদের অনলাইন সুরক্ষা ও গোপনীয়তার সাথে আপস করে তাঁদের জীবনে দৈনিক হেনস্থা আর গভীরভাবে অনুচিত নানারকম হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে বিকল্প কোনও রাজনৈতিক দর্শন বা প্রকল্পগঠনের (যেমন ইন্টারনেটের গণতন্ত্র বৃদ্ধি) পথ রুখে যায়, আশা নিভে যায়।
তার ওপর, যাঁরা নারী, যাঁরা বিভিন্নলিঙ্গপরিচয়ধারনকারী, যাঁদের চামড়া সাদা নয়, তাঁদের ইন্টারনেটে হেনস্থা হওয়ার ও গালিগালাজ খাওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। ‘দি ইউনাইটেড নেশান্স রিপোর্ট অন সাইবার ভায়োলেন্স এগেন্স্ট উওমেন অ্যান্ড গার্লস’-এর মতে ৭৩% নারী কোন না কোন ভাবে অনলাইন হিংসার সম্মুখীন বা শিকার। এই প্রান্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা অফলাইন জগতে বৈষম্যের শিকার তো বটেই, কিন্তু অনলাইন জগতে নিজেদের মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে গিয়েও এঁরা যথেষ্ট বৈরিতার মুখোমুখি হ’ন। আমাদের এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোপনীয়তা-প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জানা উচিত যাতে আমরা এমন এক ইন্টারনেট গড়ে তুলতে পারি যেখানে সবাই স্বচ্ছন্দ ও স্বাগত। যে ইন্টারনেটে গোপনীয়তা মানে শুধু ব্যক্তিমানস প্রকাশে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি নয়। অনলাইনে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অধিকার বজায় রাখাও সেই গোপনীয়তার অঙ্গ। বিভিন্ন ইন্টারনেট কর্পোরেশনের গোপনীয়তা সংক্রান্ত নীতিমালা বেশীর ভাগ সময় অনলাইন বৈচিত্রবৃদ্ধি আর অংশগ্রহণের পথ সুগম করার বদলে আরও দুর্গম করে তোলে। যেমন ফেসবুকের ‘রিয়্যাল নেমস’ নীতি, যা এলজিবিটিকিউআই এবং দেশজ আমেরিকান সম্প্রদায়ের বেশ ক্ষতি করেছিলো।
যে সব প্রশ্ন আমাদের খুব কাছের:
- ভূগোল, শ্রেণী, জাতি ও লিঙ্গবিশেষে গোপনীয়তা আর বিশেষাধিকার কি কি ভাবে যুক্ত?
- গোপনীয়তার অধিকার কার গোপনীয়তা রক্ষা করে? কার সুরক্ষার দাম বেশি?
- গোপনীয়তা যে শুধু অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি নয়, তার চেয়েও বেশী এক সুরক্ষার অঙ্গীকার – তা আমরা কিভাবে বুঝব আর বোঝাবো?
- ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আর ডাটা-নীতিকারের মধ্যে জ্ঞানের যে ব্যবধান তার ওপর কি করে সেতু বাঁধবো আমরা?
- যে সব প্রযুক্তি প্রকল্প আমাদের গোপনীয়তারক্ষাকাজে নিয়োজিত সেগুলির আর যেসব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ঝুঁকির মধ্যে, তাঁদের মধ্যে সংহতি সংঘ কি ভাবে গড়ে তুলবো আমরা?
Translation: Sourav Roy